Header Ads Widget

Responsive Advertisement

আড়ালে

 আমার স্বামীর সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিলো অপ্রত্যাশিতভাবে। আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না। তার সাথে পরিচিত হবার কথাও ছিলো না। আমি তার গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ফেসবুকে গল্প লিখতো সে, আমি নিয়মিত পড়তাম। একদিন অনেক সাহস করে একটা কমেন্ট করলাম, 'সুন্দর হয়েছে গল্পটা।' এরপর অপেক্ষা করতে লাগলাম তার রিপ্লাইয়ের।

এক ঘন্টা, দু ঘন্টা, তিন ঘন্টা গেলো, তার রিপ্লাই আর পেলাম না। এতো এতো প্রশংসার ভীড়ে আমার 'সুন্দর হয়েছে' কথাটা হয়তো হারিয়ে গেলো।‌ খারাপ লাগছিলো, খুব খারাপ লাগছিলো।
তারপর, হঠাৎ টুং করে নোটিফিকেশনের শব্দটা কানে এলো। আমি যেন নিজেই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এটা কি সত্যি? আমার প্রিয় লেখক আমার কমেন্টের রিপ্লাই দিয়েছেন? তিনি দেখেছেন আমার কমেন্টটা, আমার নামটা?
হ্যাঁ, সত্যি। তিনি আমার কমেন্টের রিপ্লাই দিয়েছেন।‌ছোট করে লিখেছেন, ধন্যবাদ। সেই ধন্যবাদটুকু যে কি ভীষণ রকম আনন্দের এক হাওয়া বইয়ে দিলো আমার মনে, আমি বলে বোঝাতে পারবো না।
এরপর, কমেন্টে টুকটাক কথা হতো।
একদিন, দিনটা আমার মনে আছে, ২৪শে অক্টোবর ২০২১। হালকা হালকা বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন। রাতে একটু ঠান্ডাও পড়েছিলো, আমি কাঁথাটা সুন্দর মতো গায়ে দিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে চলেছি, হঠাৎ করে ম্যাসেঞ্জারের নোটিফিকেশন বেজে উঠলো। কেউ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। দেখতে ইচ্ছে করছিলো না। তবুও গুরুত্বপূর্ণ কোন ম্যাসেজ কিনা এইটা ভেবে দেখলাম।
স্ক্রিনে ম্যাসেজ প্রেরকের নামটা যখন পড়লাম, সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সে। সে আমাকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। এটা কি সম্ভব? এতো এতো মানুষের ভীড়ে আমাকে চিনে নিয়ে আলাদাভাবে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে সে, আমার এতো সৌভাগ্য হলো কবে থেকে?
তার 'হাই' এর উত্তরে অনেক ভেবে কাঁপা হাতে কেবল 'হ্যালো' লিখতে পারলাম। দুই মিনিটের নীরবতা। তারপরই সে সিন করলো।‌ আর কিছুক্ষণ পরই তার ম্যাসেজ-
'এখনো জেগে আছেন?'
'জি।'
'যাক। ভেবেছিলাম আপনাকে পাবো না।'
'কেন?'
'সুন্দরী মেয়েরা রাতে অনলাইনে থাকে না। থাকলেও ব্যস্ত থাকে অন্য কাউকে নিয়ে।'
'আপনি ভুল করছেন। আমি সুন্দরী না। আর আমার কেউ নেই।'
'কি যে বলেন। কে বলে আপনি সুন্দরী না? আপনি ভয়ংকর সুন্দর।‌ আগুন সুন্দরী কথাটা শুধু আপনার জন্যই সৃষ্টি হয়েছিলো।'
'সত্যি বলছেন?'
'মিথ্যা কেন বলবো?'
'আমাকে কেউ কখনো এভাবে বলেনি।'
'কারণ তাদের দেখার চোখ নেই।'
আমরা অনেকক্ষণ গল্প করলাম। যখন আমাদের কথা শেষ হলো, ঘড়িতে তখন দেখি চারটা বাজে। আমরা সারারাত কথা বলে পার করে ফেলেছি।
এর ঠিক একমাস পর, আমাদের রোজ রোজ কথা বলার ত্রিশটি রাত পর, শাফি আমায় প্রপোজ করলো।
আমার না করার কিছু ছিলো না। তার গল্পের প্রেমে পড়েছিলাম, তারপর তার কথার, তারপর তার।
আমাদের প্রেম চলছিলো। বাসা থেকেও তখন বিয়ের জন্য চাপাচাপি করছিলো।‌ ওর কথা বাসায় বললাম। রাজি হলো না। বাবা খোঁজ খবর নিয়ে বললেন, 'ছেলের চাকরিটা ছোটখাটো, ফ্যামিলিও তেমন ভালো না। এখানে বিয়ে না করাই ভালো।'
আমার কি তখন আব্বার কথা শোনার মতো অবস্থা আছে? আমি শাফিতে মজে গেছি। একদিন আমরা পালিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। বাসা থেকে আমাদের মেনে নিলো না। আমি গিয়ে উঠলাম শাফির বাসায়। দুরুমের ছোট্ট ফ্ল্যাট। ওতেই আমরা সংসার সাজিয়ে নিলাম।
ভালোই কাটছিলো আমাদের দিন। সুন্দর মতো কাটছিলো। ছ'মাস যাওয়ার পর আস্তে আস্তে সব বদলে গেলো। প্রথম প্রথম বদলটা আমার চোখে পড়েনি। তাহলে হয়তো এই বদলে যাওয়াটা আটকাতে পারতাম।
প্রথমে ওর মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো কমে গেলো।আগে রাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কথা বলতো ও, তার বদলে তখন মোবাইলের ভেতর ডুবে গেলো। আমি জিজ্ঞেস করতাম, 'কি দেখ?' সে বলতো, 'নতুন এক গল্প লিখেছি। এখন কমেন্টগুলো দেখছি একটু।'
আমি বাধা দিতাম না। হাজার হোক, লেখক তো। পাঠকরাও তো ওর জীবনের অংশ, তাদেরও তো সময় দেওয়ার দরকার। আমাকে বিয়ে করেছে বলে এই জিনিসটা তো তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারি না‌। তাই ওকে এ ব্যাপারে বিরক্ত করতাম না।
একদিন দেখলাম, ফেসবুকে ওর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস হাইড করা। জিজ্ঞেস করলাম, 'এমন করলে কেন?' বললো, 'এইটা পাঠক ধরার ট্রিক। জানো, ফেসবুকে গল্প পড়ে তো বেশি টিনএজ মেয়েরা। ওরা রাইটারকে নিয়ে একটু ফ্যান্টাসিতে ভোগে। রাইটার বিবাহিত জানলে ওদের ফ্যান্টাসি করতে অসুবিধা হয়। লেখার রিচও কমে যায়। এটুকু বুঝো না কেন?'
'আমি কেন তোমাকে অন্যের ফ্যান্টাসি হতে দেবো?'
'প্লিজ, এমন করো না। তুমি তো জানো আমার কতো ইচ্ছা পপুলার হবার। আমি গল্প লিখে পপুলার হতে চাই। এইজন্য যা করার আমি করবো। প্লিজ, তুমি এইসবে কোনো ঝামেলা করো না।'
আমি ঝামেলা করি নাই। মেনে নিয়েছিলাম।
এরপর ওর আদরগুলো কমে গেলো। রাতে ঘুমাবার আগে, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর, অফিসে যাওয়ার আগে, অফিস থেকে ফেরার পর যে মিষ্টি আদরগুলো বরাদ্দ ছিলো আমার জন্য, কমে গেলো কেন যেন। ও নাকি ভুলে যায়। এমন জিনিস কিভাবে কেও ভোলে?
তারপর, ওর কথা বলা কমে গেলো। অফিস থেকে এসেই ফোন নিয়ে বিজি। আগে ভাবতাম শুধু কমেন্টের রিপ্লাইগুলোই দেয়। এখন বুঝলাম সে চ্যাটিংও করে। ম্যাসেজের তোড়ে তার হাত ঝড়ের মতো চলতে থাকে মোবাইলের ওপর। অথচ আমাকে দেওয়ার মতো সময় সে পায় না। সারাদিন আমি বাসায় থাকি। একা থাকি। তার সাথে কথা বলার জন্য মনটা ছটফট করে। সে আসে। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। আমার সারাদিনের জমানো কথাগুলো তাকে জানাতে চাই। তার কথা শুনতে চাই। যেই কথার প্রেমে পড়ে তার জন্য পাগল হয়েছিলাম একদিন, সেই কথা শুনতে চাই। সে শুধু কথা বলুক। কোনো গল্প না, সারাদিনের অফিসের কাজের ফিরিস্তি না, কোনো মেঘলা দিনের কবিতা না। সে শুধু পাগলের প্রলাপ বলুক। তবুও কথা বলুক। আমি তার কথা শুনতে চাই।
কিন্তু, তার সময় হয় না।
তারপর, একদিন তার ইনবক্স দেখলাম। আমার বুকটা ভেঙে গেলো। আমার জন্য যে মিষ্টিকথাগুলো বরাদ্দ ছিলো, সেগুলো এখন অন্য অনেকের হয়ে গেছে।
আমি অনেক কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে তাকে বললাম, 'তুমি এমন করলে কেন আমার সাথে?'
সে উল্টো প্রচন্ড রেগে গেলো। রেগে গিয়ে বললো, 'আমার পার্সোনাল জিনিস তুমি দেখলে কেন?'
'তোমার পার্সোনাল জিনিস? তোমার কি পার্সোনাল থাকতে পারে আমাকে লুকানোর মতো? আমি তোমার বউ।'
'বউ ঠিক আছো। বউকে তো বউয়ের মতোই রেখেছি। তোমাকে কোন কাজ করতে দেই না, ঘরে পুতুলের মতো করে রেখে দিয়েছি। কোনো কষ্টও দেই না, অসম্মানও করি না। আর কি চাও?'
'তাই বলে, তুমি অন্যদের সাথে এইভাবে কথা বলবে?'
'শুনো, রোজ রোজ একই জিনিস খাইতে ভালো‌ লাগে না। রোজ রোজ একই বউয়ের সাথে কথা বলতেও ভালো লাগে না। অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলতেছি, এটা আমার আনন্দ, আমার শখ। এই শখটা কেড়ে নেয়ার অধিকার তোমার নাই। আর শুধু কথাই তো বলছি, অন্য কিছু তো করছি না। এতো জ্বলে কেন তোমার?'
আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওর কথাগুলো শুনে। কিন্তু সেই অবাক হওয়া পর্যন্তই। আর কিছু করার ছিলো না আমার। আমি অসহায়ের মতো পরে পরে কাঁদলাম। সে বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আর কিছুই বললো না।
এরপর, আমাদের জীবনটা গতানুগতিক ভাবেই চলতে লাগলো। সে তার মতো থাকে, আমি আমার মতো। কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলো না আমার, পরিবার আমার থাকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো, আমি তাদের কাছে যাই কোন মুখে? আমরা সংসার করি আগের মতো, কিন্তু আগের সেই প্রেমটা আর আমাদের মাঝে রইলো না।
এর কিছুদিন পর তার মধ্যে আরেকটা বদল লক্ষ্য করলাম। অফিস থেকে ফিরে কেমন উদাস থাকে, মোবাইল চালায় ঠিকই, কিন্তু তারমধ্যেও কেমন একটা আনমনা ভাব। কি হয়েছে ওর? এই প্রশ্নটা আমার মনে আসতো, কিন্তু ওকে করা হতো না। তবে এই প্রশ্নের উত্তর কিছুদিনের মধ্যেই পেয়ে গেলাম।
একদিন সন্ধ্যায় বিছানায় শুয়ে সে আমার দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বললো, 'এই গল্পটা পড়ো। সুন্দর না?'
অনেকদিন পর ওর আদরমাখা কথা শুনলাম। আমার মনটা কেমন আনন্দে ভরে উঠলো। মোবাইলটা খুশি মনেই হাতে নিলাম। দেখলাম, একটা গল্প, একটা গ্রুপে পোস্ট করা। লিখেছে এক মেয়ে। নাম নীলাঞ্জনা মৌ।
গল্পটা পড়লাম। পড়ে ওর কাছে মোবাইলটা ফেরত দিতে দিতে বললাম, 'সুন্দর গল্প। তবে তোমার গল্পগুলোর মতো সুন্দর না।'
ও মনে হলো খুশি হলো মনে মনে, কিন্তু সেটা লুকিয়েই বললো, 'কি যে বলো। এ আরো সুন্দর লেখে। আমি ওর অনেকগুলো গল্প পড়েছি। খুব সুন্দর লেখার হাত।'
আমি আর কিছু বললাম না। নীলাঞ্জনা মৌকে নিয়ে ওর যে উচ্ছ্বাস, সেটা আমি আগেও দেখেছি। বিয়ের আগে। আমাকে নিয়ে এমন উচ্ছ্বাস ছিলো ওর।
তারপর, নীলাঞ্জনা মৌকে সে একদিন কমেন্ট করলো। গ্রুপেই দেখলাম কমেন্টটা। আমি যেমন ওকে কাঁপা কাঁপা হাতে প্রথম কমেন্ট করেছিলাম, ঠিক তেমন একটা কমেন্ট করেছে ও 'সুন্দর হয়েছে গল্পটা।'
মেয়েটা যখন ওকে রিপ্লাই দিলো, তখন তার আনন্দ আর ধরে না। সারাটাদিন সে কেমন খুশি খুশি হয়ে রইলো। তার এই খুশি খুশি ভাবটা ভীষণ পরিচিত লাগছিলো আমার কাছে। ওর প্রথম রিপ্লাই পাবার পর আমিও এমনই খুশি খুশি ছিলাম।
এরপর ঐ মেয়েটার প্রত্যেক গল্পেই সে কমেন্ট করতে লাগলো। আমি গ্রুপে দেখতাম। কমেন্টের রিপ্লাইও আসতো। কমেন্টের কথাবার্তা একসময় ইনবক্সের দিকে চলে গেলো‌। ওদের ইনবক্সের কথাগুলো দেখতাম। আমাকে বলা মিষ্টি কথাগুলো, যেগুলো এতোদিন অন্য অনেকের মাঝে বিলানো হয়েছে, সেগুলো এখন শুধু একজনের জন্যই বরাদ্দ হয়ে গেলো। মৌ মেয়েটার জন্য।
মৌয়ের সাথে তার চ্যাটিং বাড়তে লাগলো। বিয়ের আগে আর পরে আমি শাফিকে নিয়ে যেমন অবসেসড ছিলাম, সেই অবসেসনটা আমি শাফির মধ্যে দেখতে পেলাম মৌকে নিয়ে। সারারাত ও কথা বলতো মৌয়ের সাথে। অন্য মেয়েদের সাথে তার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো। আর আমি তো অনেকদিন থেকেই অনেক দূরের মানুষ তার। মাঝে মাঝে শারীরিকভাবে কাছে আসা ছাড়া অন্য কোন সম্পর্কই ছিলো না আমাদের মাঝে।
এর মধ্যে বইমেলা এলো। শাফির প্রথম বই বের হয়েছে। কিন্তু ওর বইয়ের কাটতি কমে গেলো মৌয়ের বইয়ের কাছে। মৌয়ের বই তখন বইমেলার বেস্টসেলার। ফেসবুকেও তার গল্পের রিচ শাফির থেকে অনেক বেশি। শাফির কি এ নিয়ে কোনো আফসোস আছে? বোঝা যায় না। সে তখন যেন পুরো ডুবে আছে মৌতে।
এরপর, মৌয়ের সাথে শাফির প্রথম দেখা হবার সুযোগ চলে আসলো।



দৈনিক দেশের সংবাদ প্রতিবছর বইমেলার পর সেরা বইগুলোকে পুরষ্কৃত করে। এবছরও করেছে। এ বছর তারা বর্ষসেরা বই নির্বাচন করেছে নীলাঞ্জনা মৌয়ের বই 'পুষ্পিতার গল্প'-কে। আর সেরা নবাগত লেখক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে শাফি আর নীলাঞ্জনা মৌ দুজনেই। পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠান ২৩শে মার্চ। শাফি সেই অনুষ্ঠানে যাবে। মৌয়ের সাথে দেখা হবে তার।
অনুষ্ঠানের দিন শাফি অফিস গেলো না। সারাদিন অনুষ্ঠানে যাবার প্রস্তুতি নিলো। বিকেলে একটা সুন্দর শাড়ি কিনে নিয়ে আসলো। আমি বললাম, 'এটা কি আমার জন্য?'
ও বললো, 'না, আমার এক বন্ধুর জন্য।'
শাফি জানে না, তার বন্ধুটিকে তো আমি চিনি।‌ নীলাঞ্জনা মৌ। তাদের ইনবক্সের কথা দেখা হয়ে গেছে আমার।
আমি এতোদিন চুপ করেছিলাম। আর পারলাম না। চিৎকার করে বললাম, 'কোন বন্ধুর জন্য এনেছ তা তো জানি। নীলাঞ্জনা মৌয়ের জন্য, তাই না? বন্ধুর জন্য শাড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছো, বউয়ের জন্য এমন শাড়ি কিনেছো কোনোদিন?'
শাফি বললো, 'চুপ করো।'
'কেন চুপ করবো। বলো তো শাফি। আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছি। তোমার জন্য আমি ফ্যামিলি রিলেটিভ সবকিছু ফেলে চলে এসেছি। অথচ তুমি আমাকে ফেলে বাইরের একটা মেয়ের সাথে ঘুরছো।এটা কি ঠিক শাফি? বলো, ঠিক?
শাফি বললো, 'প্লিজ চুপ করো।'
'আমি চুপ করবো। তবে ঐ মৌ মেয়েটার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে।'
'আমি পারবো না।'
'তাহলে জানবো, তোমার মতো অসভ্য ইতর আর একটাও নাই।'
শাফি আর কিছু বললো না। ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলো আমার গালে। আমি ভাবতেও পারিনি আমার সাথে কখনো সে এমন করতে পারে। অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আমাকে শক্ত করে ধরে বললো, 'আমি কই যাই, কি করি, কার সাথে শুই এগুলো তোর দেখার ব্যাপার না। আমি আমার লাইফকে নিজের মতো চালাবো। তুই আমারে কিছু বলার কে? বাড়ির বউ, বাড়ির বউয়ের মতো থাকবি। জামাইয়ের ওপর খবরদারি করতে আসবি না।'
সে চলে গেলো অন্য ঘরে। আমি অনেক কষ্টে কান্না আটকালাম।
সন্ধ্যায় শাফি খুব সুন্দর করে তৈরি হলো।‌ ওর সবচেয়ে সুন্দর পাঞ্জাবিটা পড়লো। সবচেয়ে দামি ঘড়িটা পড়লো। সবচেয়ে সুঘ্রাণের পারফিউমটা মাখলো গায়ে। এরপর মিষ্টি এক গানের লাইন গুনগুন করতে করতে চলে গেলো বাইরে। আমাকে কিছু বললো না। কিছু বলার প্রয়োজনও মনে করলো না। আমি তখন কেউ না ওর জন্য।
আমি আর পারলাম না। কাঁদলাম, অনেক কাঁদলাম। তারপর বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলাম। আমার আজকে অনেক কাজ করা বাকি।
আলমারি থেকে শাড়িটা বের করলাম। আমার প্রিয় ব্ল্যাক‌ কালার শাড়িটা। প্রিন্সেস ডায়ানা যখন জানতে পারেন, প্রিন্স চার্লস তার সাথে প্রতারণা করেছেন তখন তিনি কালো রঙের এক গাউন পরেছিলেন। এরপর তার রুপচর্চাকারীদের বলেছিলেন, তাকে সবচেয়ে সুন্দর করে সাজাতে, যাতে পৃথিবী বুঝতে পারে, চার্লস কি হারালো। আমিও আজকে সাজবো। সবচেয়ে সুন্দর করে সাজবো।
শাফি আমাকে এতোই অবহেলা করছিলো, যে তার পাশে শুয়ে আমি কি করছিলাম, কার সাথে ম্যাসেজিং করছিলাম, সেসবের দিকে একবার ফিরেও দেখেনি। সারাদিন আমার কিভাবে কাটে, আমি কি করি তার কোন খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি। সে এতোটাই মজে গিয়েছিলো নীলাঞ্জনা মৌয়ের মাঝে, যে কখনো জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করেনি কেন মৌ কখনো তার আসল ছবি ব্যবহার করে না ফেসবুকে। কেন মৌয়ের প্রকাশিত বইয়ে তার কোনো ছবি নেই। কেন মৌ তাকে কোন ছবি দিতে চাইতো না। কেন মৌ রাতে কল দিতে মানা করতো, কেবল সকালে অফিস টাইমেই কল দিতো সে। কেন মৌয়ের কল আর অডিও ম্যাসেজগুলোতে তার কণ্ঠ এমন চাপা চাপা, ভাসা ভাসা শোনাতো, যেন সে তার আসল কণ্ঠ ঢাকতে চাইছে। এসব কিছুই জানার প্রয়োজন মনে করেনি সে। সে শুধু মৌয়ের সাথে বলেই খুশি ছিলো। আর কিছু লাগতো না তার।
আজ যখন সে পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে আমাকে দেখবে, তখন তার কেমন লাগবে? আমি, নীলাঞ্জনা মৌ, যখন তার অসহ্য খারাপ ব্যবহারগুলো মানুষের সামনে বলবো, তখন তার মুখের ভাবটা কেমন হবে? আমি জানবো, সব জানতে পারবো। আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা।
সমাপ্ত ~


Post a Comment

0 Comments